কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মার্ক কারনি যখন দায়িত্ব নিচ্ছেন, তখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মোকাবিলাই নয়, বরং দেশের ভেতরের নানা বিভাজনের সাথেও তাঁকে লড়তে হবে।
এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাটল দেখা দিয়েছে প্রজন্মের ভেতর। তরুণ ভোটাররা যাঁরা বাড়িভাড়া, অপরাধপ্রবণতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাঁদের একটি বড় অংশ এখন কনজারভেটিভদের দিকে ঝুঁকেছেন।
২০১৫ সালে চিত্রটা ছিল একেবারে উল্টো। সেই সময়ে রেকর্ডসংখ্যক তরুণ ভোট দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন নেতা জাস্টিন ট্রুডোর জয়কে নিশ্চিত করেছিল।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে ষাটোর্ধ্ব প্রজন্ম—যাঁদের “বেবি বুমার” বলা হয়—লিবারেলদের সাফল্যের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি ছিলেন, বললেন অ্যাবাকাস ডেটার পোলস্টার ডেভিড কোলেত্তো।
অন্যদিকে তরুণ কানাডীয়রা, বিশেষ করে তরুণ পুরুষেরা, এবার কনজারভেটিভদের পক্ষে জোরালো সমর্থন দেখিয়েছেন।
তাদের একজন টরোন্টোর কনর, বয়স ২৮। বিবিসিকে তিনি বলেন, তাঁর কনজারভেটিভপ্রীতির কারণ হলো দলের বাড়িভাড়া ও খরচের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া।
তিনি বলেন, “আমরা এমন এক ব্যবস্থার মধ্যে আটকে গেছি যা আমাদের জন্য কাজ করছে না। এটি আমাদের মা-বাবাদের জন্য হয়তো কাজ করেছে, কিন্তু আমাদের জন্য নয়।”
তিনি আরও বলেন, গত ১০ বছর ধরে একই লিবারেল নীতিতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
আরেক তরুণ ভোটার, মন্ট্রিয়ালের ২৯ বছরের এক নারী যিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি, বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডার অর্থনৈতিক অগ্রগতির অভাব তাঁকে হতাশ করেছে।
“আমি ছয় অঙ্কের আয় করি, কিন্তু আমার টাকার ক্রয়ক্ষমতা এখন আগের মতো নয়। বিষয়টি আমাকে সত্যিই চিন্তিত করে,” বলেন তিনি।
নির্বাচনের আগে ২৫ এপ্রিলের একটি ন্যানোস জরিপে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে কনজারভেটিভদের সমর্থন ছিল ৪৪%, যেখানে লিবারেলদের সমর্থন ছিল মাত্র ৩১.২%।
বিভিন্ন বয়সের মানুষের কাছে বিভিন্ন ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারনি নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি জোর দিয়ে বললেও, পিয়েরে পয়েলিয়েভ্রের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ দল মূলত জীবনযাত্রার ব্যয় ও ভেঙে পড়া “কানাডিয়ান স্বপ্ন”-এর প্রসঙ্গ তুলে ধরেছে।
অ্যাবাকাস ডেটার জরিপ বলছে, ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মাত্র ১৮% ট্রাম্প নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে সেই হার ছিল ৪৫%। এই পার্থক্য প্রজন্মভিত্তিক ইস্যুতে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা তুলে ধরে।
সোমবারের নির্বাচনে লিবারেলরা এক ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনে এক ডজনের বেশি আসন পেয়ে গেলেও, কনজারভেটিভরাও উল্লেখযোগ্যভাবে নিজেদের আসন বাড়িয়েছে। ফলে লিবারেলরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করতে পারেনি।
লিবারেলরা পেয়েছে ১৬৯টি আসন, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাত্র তিনটি কম। আর তারা পেয়েছে মোট ভোটের ৪৩%। অন্যদিকে কনজারভেটিভরা পেয়েছে ১৪৪টি আসন, যা ২০২১ সালের নির্বাচনের তুলনায় ২৫টি বেশি। তারা পেয়েছে ৪১% ভোট।
ছোট দলগুলোর, বিশেষ করে বামঘেঁষা নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি), বড় ক্ষতি হয়েছে এই নির্বাচনে। অনেক ভোটার বড় দুই দলে ঝুঁকেছেন।
জয়ের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী কারনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি সব কানাডীয়দের জন্য সরকার চালাবেন।
তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকারে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনাও ছিল—যেমন বছরে পাঁচ লাখ নতুন ঘর নির্মাণের প্রতিশ্রুতি এবং কিছু কানাডীয়ের জন্য ছোট আয়কর ছাড়।
ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ার লরা স্টিফেনসন বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় সংক্রান্ত ইস্যুতে লিবারেল ও কনজারভেটিভদের প্রতিশ্রুতি একেবারে ভিন্ন ছিল না।
“মূলত বিষয়টি ছিল মাত্রার পার্থক্যের—পুরোপুরি আলাদা কৌশলের নয়,” মন্তব্য করেন অধ্যাপক স্টিফেনসন।
জয়ের পর নিজের বক্তব্যে কারনি ঐক্যের বার্তা দেন। তিনি বলেন, “আপনি কানাডার যেখানেই থাকুন, যে ভাষাতেই কথা বলুন, যেভাবেই ভোট দিন না কেন—আমি সর্বদা আপনাদের সবার প্রতিনিধিত্ব করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
কারনির সামনে আরেক বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কানাডার পশ্চিমাঞ্চল। ওখানে রাজধানী অটোয়ার প্রতি দীর্ঘদিনের উপেক্ষার বোধ রয়েছে।
এই উত্তেজনা দ্রুতই প্রকাশ পেয়েছে। কারনিকে অভিনন্দন জানানো এক পোস্টে আলবার্টার প্রিমিয়ার ড্যানিয়েল স্মিথ বলেন, পয়েলিয়েভ্রের দৃষ্টিভঙ্গি “কোটিকোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে”, কিন্তু লিবারেলরা তাঁর তেলসমৃদ্ধ প্রদেশকে “অপমান ও কলঙ্কিত করেছে”।
তিনি কারনির প্রতি আহ্বান জানান যেন অটোয়া ও আলবার্টার সম্পর্ক “আসল পদক্ষেপের মাধ্যমে” পুনর্গঠন করা হয়, “শুধু কথার ফুলঝুরি দিয়ে নয়”।
কারনির দল এখন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছাতে পারেনি। তাই আইন পাস করাতে হলে তাঁকে অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হবে। লিবারেলরা এনডিপি বা এমনকি কনজারভেটিভ দলের কিছু সদস্যকেও পাশে টানার চেষ্টা করতে পারে। এভাবে হয়তো সংখ্যালঘু সরকারও কার্যকর রূপ নিতে পারে।
একটি কার্যকর সরকার গঠন এবং কানাডার ভৌগোলিক ও প্রজন্মভিত্তিক বিভাজন মেরামত করা এখন কারনির কাজের তালিকায় উপরের দিকেই রয়েছে।
বিবিসি থেকে