কানাডার ভিতরেই আওয়াজ: আমেরিকার সঙ্গে আমাদের মিল বেশি

User avatar placeholder
Written by piash2004

April 27, 2025

পশ্চিম কানাডার কিছু বাসিন্দা, যারা লিবারেল শাসনের এক দশকে ক্লান্ত, প্রকাশ্যে বিচ্ছিন্নতার দাবি তুলেছেন। তারা বলছেন, আমেরিকার সঙ্গে আমাদের মিল কানাডার অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেক বেশি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য কানাডার সার্বভৌমত্বের ওপর যেভাবে প্রশ্ন তুলেছে, তা এ নির্বাচনের মূল আলোচ্য হয়ে উঠেছে। তবে দেশের ভেতর থেকেও এখন এইভাবে নতুন চ্যালেঞ্জ মাথাচাড়া দিচ্ছে। 

লেথব্রিজ শহরের একটি ছোট সভাকক্ষে গাদাগাদি করে জড়ো হওয়া প্রায় ১০০ জন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে, ডেনিস মড্রি আলবার্টার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

তিনি জানতে চান—কে কে মনে করেন আলবার্টার উচিত কানাডায় বড় ভূমিকা নেওয়া? এক ডজনের মতো মানুষ হাত তুললেন।

এরপর প্রশ্ন করলেন—আলবার্টা কি কানাডা থেকে আলাদা হয়ে নিজের রাষ্ট্র গড়বে? এবার প্রায় অর্ধেক শ্রোতা হাত তুললেন।

“কয়জন চান আলবার্টা আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হোক?” আবার অর্ধেক মানুষের সমর্থন মিলল।

ডেনিস মড্রি, অবসরপ্রাপ্ত হৃদরোগ সার্জন, বর্তমানে আলবার্টা প্রসপারিটি প্রজেক্টের সহ-নেতা। এই সংগঠন স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটের দাবি তুলেছে।

আলবার্টার বিচ্ছিন্নতার আলোচনা নতুন নয়। তবে ট্রাম্পের কানাডাকে ৫১তম রাজ্যে পরিণত করার মন্তব্য এবং এরপর লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে এই বিষয়টি নতুন গতি পেয়েছে।

মড্রি বিবিসিকে জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই আন্দোলনের প্রসার ঘটেছে—আর এর পেছনে ট্রাম্পের কথাবার্তার প্রভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

“আমরা আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হতে চাই না,” তিনি বললেন। “আমরা চাই আলবার্টার সার্বভৌমত্ব।”

তবে ক্যালগের আইনজীবী ও খামার মালিক জেফরি রাথ, যিনি প্রকল্পের আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ট্রাম্পের প্রস্তাব পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি। যদিও তার কাছে স্বাধীনতা অগ্রাধিকার, তিনি ভবিষ্যতে আলবার্টার আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও দেখেন।

তিনি বলেন, “আমাদের মন্টানার প্রতিবেশী কিংবা টেক্সাসের আত্মীয়দের সঙ্গে সাংস্কৃতিক মিল কানাডার অন্য অংশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।”

পূর্বে যেখানে এই চিন্তাভাবনা রাজনৈতিক প্রান্তিকতায় সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা প্রকাশ্য আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

“গ্লোব অ্যান্ড মেইল”-এ এক মতামত নিবন্ধে আধুনিক কানাডিয়ান কনজারভেটিভ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ প্রেস্টন ম্যানিং সতর্ক করেছেন—”অনেক পশ্চিম কানাডাবাসী আর চার বছরের লিবারেল শাসন মেনে নেবে না, নেতা যেই হোক।”

তিনি অভিযোগ করেছেন, লিবারেল পার্টি জাতীয় বিষয়গুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং পশ্চিম কানাডাবাসীর অগ্রাধিকারকে অবহেলা করেছে। তিনি লিখেছেন, “কার্নি লিবারেলদের পক্ষে ভোট মানেই পশ্চিমের বিচ্ছিন্নতার পক্ষে ভোট—মানে কানাডার ভাঙনের পক্ষে ভোট।”

পশ্চিমাঞ্চলের বঞ্চনা’

‘পশ্চিমাঞ্চলের বঞ্চনা’—এই অনুভূতি নতুন নয়। বহু দশক ধরেই তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ প্রেইরি প্রদেশ আলবার্টা ও সাসকাচেওয়ানের বাসিন্দারা অভিযোগ করে আসছেন, দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তারা রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষিত।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর শাসনকালে পরিবেশনীতি গ্রহণের ফলে এই ক্ষোভ আরও বাড়ে, যা আলবার্টার আর্থিক অগ্রগতির ওপর আঘাত হিসেবে দেখা হয়।

জাতীয় সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, লিবারেলরা, এখন মার্ক কার্নির নেতৃত্বে, সোমবারের নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অন্টারিও এবং কুইবেক—দেশের জনবহুল পূর্বাঞ্চল থেকে সমর্থন বাড়ায়, এই বিভাজন আরও গভীর হয়েছে।

ক্যালগের তেলশিল্পে কর্মরত এক ব্যক্তির স্ত্রী জুডি স্নাইডার, বিবিসিকে বলেছেন, স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট হলে তিনি ‘হ্যাঁ’ ভোট দেবেন।

তার মতে, কার্নি—যিনি এডমন্টনে বেড়ে উঠলেও, গত এক দশক দেশের বাইরে কাটিয়েছেন—আলবার্টার আসল সন্তান নন।

“সে এসে বলতেই পারে ‘আমি আলবার্টার ছেলে’, কিন্তু আসলে কি তাই?” বললেন স্নাইডার।

তবে আলবার্টার স্বাধীনতার সম্ভাবনা এখনো দুরূহ। সাম্প্রতিক অ্যাঙ্গাস রিড সমীক্ষা বলছে, এখন গণভোট হলে কেবল প্রতি চারজনের একজন আলবার্টাবাসী বিচ্ছিন্নতার পক্ষে ভোট দেবেন। তবে ন্যানোসের আরেক সমীক্ষা অনুযায়ী, বেশিরভাগ কানাডিয়ান মনে করেন এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এই বিভাজন দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে, বিশেষ করে যদি কার্নি জয়ী হন। এমনকি যদি ক্যালগের সন্তান কনজারভেটিভ নেতা পিয়ের পলিয়েভ্রে জেতেন, তবুও পূর্ব-পশ্চিমের ভারসাম্যহীনতা থেকেই যাবে, বলছেন মড্রি।

এই বিস্তৃত ক্ষোভ আলবার্টার প্রিমিয়ার ড্যানিয়েল স্মিথকে নিজস্ব পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায়। যেখানে অন্যান্য প্রদেশ ও ফেডারেল সরকার মিলিতভাবে কাজ করেছে, স্মিথ আলাদাভাবে আলোচনা চালিয়েছেন। এমনকি ট্রাম্পের মার-আ-লাগো আবাসে গিয়েও দেখা করেছেন।

স্মিথ সতর্ক করেছেন, যদি নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ছয় মাসের মধ্যে আলবার্টার দাবিগুলো—বিশেষ করে ট্রুডো আমলের পরিবেশ আইন বাতিল করে তেল ও গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে—পুরণ না হয়, তাহলে “জাতীয় ঐক্য সংকট” দেখা দেবে।

যদিও তিনি সরাসরি বিচ্ছিন্নতার কথা অস্বীকার করেছেন, সমালোচকরা মনে করেন তিনি এমন সংকটময় সময়ে উত্তেজনাকে আরও উস্কে দিচ্ছেন।

বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনেও বিভেদ

বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ভেতরেও কৌশলগত বিভেদ রয়েছে।

লেথব্রিজের সভায় উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবক লর্ণা গুইটন বিবিসিকে বলেছেন, তার লক্ষ্য কানাডার সঙ্গে আলবার্টার সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো।

তার মতে, বর্তমান বন্ধনটি “ভেঙে গেছে”, এবং তিনি মনে করেন গণভোটের হুমকিই আলবার্টার জন্য ভবিষ্যৎ আলোচনায় ‘লিভারেজ’ তৈরি করবে।

তবে গুইটন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।

“ওদের নিজেদেরই অনেক সমস্যা রয়েছে। আমি কেন সেটার অংশ হতে যাব?” বললেন তিনি। “আমি চাই, হয় আলবার্টা সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকুক, নয়তো কানাডার মধ্যে একটা ভালো চুক্তির আওতায় থাকুক।”

কুইবেকে দেশপ্রেমের জোয়ার, ট্রাম্পের মন্তব্যে কাঁপছে কানাডা
কানাডার নির্বাচনের মূল প্রতিযোগীরা এখন জীবাশ্ম জ্বালানিকে প্রাধান্য দিচ্ছে, জলবায়ু ইস্যু পেছনের সারিতে

ক্যালগের শহরতলির র‍্যাঞ্চে, নিজের রেসের ঘোড়াগুলো দেখাশোনা করতে করতে, জেফরি রাথ বলেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ছোট সরকারের দর্শন—এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে আলবার্টা ও আমেরিকার অনেক মিল রয়েছে।

“এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আমি মনে করি আলবার্টা আমেরিকার ভালো একটি অংশ হতে পারে,” বললেন তিনি।

তিনি এখনো একটি “তথ্য অনুসন্ধানী” প্রতিনিধি দল গঠনের চেষ্টা করছেন, যারা ওয়াশিংটন ডিসি সফর করে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলবে।

তবে আলবার্টার অনেক ভোটার স্বাধীনতার ভাবনাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, যদিও তারা পশ্চিমের প্রতি অবহেলা মেনে নেন।

লেথব্রিজের স্টিভ লকলান বললেন, “আমরা ইতিমধ্যেই বিচ্ছিন্ন, আমাদের এক হওয়া দরকার।”

লিবারেল পার্টিও পুরোপুরি আলবার্টা থেকে মুছে যায়নি। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এবারে এডমন্টন ও ক্যালগের শহরাঞ্চলে নতুন আসন তৈরির ফলে আরও কিছু লিবারেল এমপি নির্বাচিত হতে পারেন।

ক্যালগের কেন্দ্র এলাকার বাসিন্দা জেমস ফরেস্টার জানান, তিনি আগে কনজারভেটিভ সমর্থক ছিলেন, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটু বামঘেঁষা মনোভাব পোষণ করছেন। এবার তিনি ‘কার্নি ফ্যাক্টর’-এর কারণে লিবারেলদের ভোট দেবেন।

“আমি মনে করি ট্রাম্পের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য কার্নিই সেরা মানুষ,” বললেন তিনি। আর বিচ্ছিন্নতার চিন্তা? “আমি সেটা নিয়ে চিন্তিত নই।”
সূত্র: বিবিসি

Image placeholder

Leave a Comment