শরিফুল হাসান
দেশ তাদের ভাবে টাকার যন্ত্র, আর বিদেশ ভাবে তুচ্ছ মানুষ ৷ কিন্তু এই প্রবাসীদের যদি বাংলাদেশ আরেকটু সম্মান দেয় বিদেশিরাও দেবে ৷
সমাজবাংলাদেশমধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার: বেশি খরচ, কম আয়শরিফুল হাসানঅতিথি সংবাদভাষ্য19.04.2024১৯ এপ্রিল ২০২৪দেশ তাদের ভাবে টাকার যন্ত্র, আর বিদেশ ভাবে তুচ্ছ মানুষ ৷ কিন্তু এই প্রবাসীদের যদি বাংলাদেশ আরেকটু সম্মান দেয় বিদেশিরাও দেবে ৷বিজ্ঞাপনমক্কায় বাংলাদেশি হোটেলমক্কার কাছে মিসফালাহ এলাকার হেটেল-রেস্তোরাঁ আর দোকানপাটের সাইনবোর্ড দেখে বাংলাদেশ বলে মনে হতে পারেছবি: Shariful Hasan/DWসৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর জেদ্দায় তখন শেষ বিকেল৷ তারিখটা ১৫ এপ্রিল, ২০২৪৷ লোহিত সাগরের পাড়ের শহরটির প্রিন্স ফয়সাল ইবনে ফাহাদ সড়কটিতে তখন সূর্যাস্ত দেখতে আসা মানুষের ভীড়৷ ওই সময়ে সেখানে পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন এক তরুণ৷ কথা বলতেই জানা গেল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি৷ অনেক স্বপ্ন নিয়ে মাসখানেক আগে এলেও কাজের ধরন, বেতন সবকিছু নিয়ে তিনি এখন চিন্তিত৷ দুশ্চিন্তার বড় কারণ মাত্র তিনমাসের ইকামা বা কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷ তিনমাস পর থাকতে পারবেন নাকি দেশে চলে যেতে হবে জানা নেই৷ থাকলেও যে বেতন পাবেন তাতে কতোদিনে খরচের পাঁচ লাখ টাকা উঠবে তাও জানেন না৷গত সাতদিনে সৌদি আরবের রাস্তাঘাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকান থেকে শুরু করে মসজিদ যে কোন স্থানে গিয়েই চোখে পড়েছে বাংলাদেশিদের৷ মক্কার কাছে মিসফালাহ এলাকার হেটেল-রেস্তোরাঁ আর দোকানপাটের সাইনবোর্ড ও কথা শুনে বাংলদেশের কোন এলাকা মনে হতে পারে৷ দীর্ঘ আলাপে সৌদি প্রবাসীরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে একেকজনের সৌদি আরবে আসতে খরচ গড়ে পাঁচ লাখ টাকা৷ ভারত, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল কোন দেশের প্রবাসীদের এত টাকা খরচ করে আসতে হয় না৷ অথচ অধিকাংশ বাংলাদেশি পাঁচ-সাত লাখ টাকা খরচ করেও দেশে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠাতে পারেন না৷এই কথার সত্যতা মেলে প্রবাসী আয়ের তথ্যে৷ মনিরের মতো ১৬ লাখ নতুন কর্মী গত তিনবছরে সৌদি আরবে এসেছেন৷ আর আগের কর্মী ধরলে নতুন পুরাতন মিলিয়ে দেশটিতে এখন ৩০ লাখ বাংলদেশি আছেন৷ বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ ও ২০২৩ সালে ২৪ লাখ লোকের বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে যার অর্ধেকই এসেছেন সৌদি আরবে৷ কর্মসংস্থানের এই রেকর্ড হলেও সৌদি আরব থেকে প্রবাসী আয় আসা ক্রমেই কমেছে৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তিনবছর আগে করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরেও সৌদি আরব থেকে ৫৭০ কোটি ডলার (৫.৭ বিলিয়ন) প্রবাসী আয় এসেছিল৷ এরপর ২০২১ সালে চার লাখ ৫৭ হাজার, ২০২২ সালে ছয় লাখ ১২ হাজার এবং ২০২৩ সালে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী দেশটিতে গিয়েছেন৷ সবমিলিয়ে তিন বছরে নতুন করে ১৬ লাখ কর্মী গেলেও প্রবাসী আয় না বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৭০ কোটি ডলার (৩.৭ বিলিয়ন) হয়েছে৷কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী আয় আসার দিক থেকে এতদিন সৌদি আরব শীর্ষে থাকলেও সেখান থেকে আয় কমায় ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে৷ অথচ ২০১৩ সাল থেকে গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে না দেশটি৷ অথচ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় এই শ্রমবাজারে ২০০৮ সালেও ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী গিয়েছিলেন৷ সর্বশেষ ২০১২ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন কর্মী দেশটিতে যায়৷ এরপর ২০১৩ সালে অক্টোবর থেকে দেশটিতে কর্মী যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়৷ গতকয়েক বছরে দেশটিতে লাখদুয়েক কর্মী গেছেন যার বড় একটি অংশ গেছে পর্যটক ভিসায়৷ ফলে তারাও নানা সংকটে আছেন৷ বারবার আলোচনা হলেও বন্ধ এই শ্রমবাজারটি পুরোপুরি চালু হয়নি৷একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ বাহরাইনেও ২০১৮ সাল থেকে কর্মী পাঠানো বন্ধ৷ অথচ ২০১৬ সালেও ৭২ হাজার কর্মী গেছেন৷ বন্ধের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ওমান৷ গতবছরের নভেম্বর থেকে দেশটি বাংলাদেশিদের নিচ্ছে না৷ ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ এক লাখ ৮৮ হাজার জন লোক যায় দেশটিতে৷ গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশীদের জন্য সব ধরনের ভিসা বন্ধের ঘোষণা দেয় ওমান সরকার৷রয়্যাল ওমান পুলিশের (আরওপি) পক্ষ থেকে বলা হয়, সব শ্রেণীর বাংলাদেশী নাগরিকদের নতুন ভিসা ইস্যু স্থগিত কার্যকর হবে৷ ওমানে টুরিস্ট ও ভিজিট ভিসায় আসা প্রবাসীদের ভিসা পরিবর্তন করার সুযোগও একই সাথে স্থগিত থাকবে৷ ওমানের পক্ষ থেকে এটি সাময়িক বলা হলেও কবে নাগাদ বাজারটি চালু হবে কেউ বলতে পারছে না৷ আবার বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই তৃতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজারটি কেন এবং কী কারণে এখনো বন্ধ হলো সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা নেই বাংলাাদেশের৷ জনশক্তি প্রেরনের সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, ওমানের শ্রমবাজারটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই বাজার খোলার ব্যাপারে সরকারের তৎপরতা চোখে পড়ছে না৷এরমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ নানা কারণে ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কিত অভিবাসন খাতের লোকজন৷ তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজার যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক কাজেই এখানকার বড় কোন শ্রমবাজার বন্ধ হলে পুরো শ্রমবাজারে তাঁর প্রভাব পড়েছে, ভবিষ্যতেও পড়বে৷ কাজেই দ্ষ কর্মী পাঠানো ও বিকল্প শ্রমবাজার গড়ে তোলা জরুরি৷কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমবাজার, প্রবাসী আয়ের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের এতো যোগসূত্রতা হলো কীভাবে? পেছনে ফিরলে দেখা যাবে, বিপুল পরিমান তেল আবিস্কারের পর ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে নতুন করে বড় ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল শীর্ষক জোটভুক্ত ছয়টি দেশ৷ ফলে তাদের বিপুল পরিমান প্রবাসী শ্রমিকের প্রয়োজন হয়৷ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি মুসলিম দেশ হিসেবে এখান থেকে কর্মী যাওয়া শুরু হয়৷ তেল ও খনিজ সম্পদ পেয়ে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি আর প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যাও বাড়তেই থাকে৷ প্রবাসীদের পাঠানো এই আয়ই পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে৷ বদলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি৷প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটির কাছে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে ছয় হাজার কর্মী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গিয়েছিল৷ এরমধ্যে আরব আমিরাতে দুই হাজার, কাতারে এক হাজার ২২১ জন, কুয়েতে ৬৪৩ জন, বাহরাইনে ৩৩৫ জন, সৌদি আরবে ২১৭ জন এবং ওমানে ১১৩ জন কর্মী গিয়েছিল৷এরপর প্রতি বছরে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক বিদেশে যেতে থাকেন৷ ১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো সেটি বছরে ৫০ হাজার ছাড়ায়৷ ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো বছরে এক লাখ কর্মীর বিদেশে যায়৷ এরপর সেটি দুই লাখ-তিন লাখ থেকে বাড়তে বাড়তে ২০০৭ সালে এক লাফে আট লাখে চলে যায়৷ ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে আট লাখ ৭৫ হাজার কর্মী বিদেশে গিয়েছিল৷ ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো সংখ্যাটি ১০ লাখ ছাড়ায় যার মধ্যে সাড়ে পাঁচ লা
খই গিয়েছিল সৌদি আরবে৷
সমাজবাংলাদেশমধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার: বেশি খরচ, কম আয়শরিফুল হাসানঅতিথি সংবাদভাষ্য19.04.2024১৯ এপ্রিল ২০২৪দেশ তাদের ভাবে টাকার যন্ত্র, আর বিদেশ ভাবে তুচ্ছ মানুষ ৷ কিন্তু এই প্রবাসীদের যদি বাংলাদেশ আরেকটু সম্মান দেয় বিদেশিরাও দেবে ৷বিজ্ঞাপনমক্কায় বাংলাদেশি হোটেলমক্কার কাছে মিসফালাহ এলাকার হেটেল-রেস্তোরাঁ আর দোকানপাটের সাইনবোর্ড দেখে বাংলাদেশ বলে মনে হতে পারেছবি: Shariful Hasan/DWসৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর জেদ্দায় তখন শেষ বিকেল৷ তারিখটা ১৫ এপ্রিল, ২০২৪৷ লোহিত সাগরের পাড়ের শহরটির প্রিন্স ফয়সাল ইবনে ফাহাদ সড়কটিতে তখন সূর্যাস্ত দেখতে আসা মানুষের ভীড়৷ ওই সময়ে সেখানে পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন এক তরুণ৷ কথা বলতেই জানা গেল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি৷ অনেক স্বপ্ন নিয়ে মাসখানেক আগে এলেও কাজের ধরন, বেতন সবকিছু নিয়ে তিনি এখন চিন্তিত৷ দুশ্চিন্তার বড় কারণ মাত্র তিনমাসের ইকামা বা কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷ তিনমাস পর থাকতে পারবেন নাকি দেশে চলে যেতে হবে জানা নেই৷ থাকলেও যে বেতন পাবেন তাতে কতোদিনে খরচের পাঁচ লাখ টাকা উঠবে তাও জানেন না৷গত সাতদিনে সৌদি আরবের রাস্তাঘাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকান থেকে শুরু করে মসজিদ যে কোন স্থানে গিয়েই চোখে পড়েছে বাংলাদেশিদের৷ মক্কার কাছে মিসফালাহ এলাকার হেটেল-রেস্তোরাঁ আর দোকানপাটের সাইনবোর্ড ও কথা শুনে বাংলদেশের কোন এলাকা মনে হতে পারে৷ দীর্ঘ আলাপে সৌদি প্রবাসীরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে একেকজনের সৌদি আরবে আসতে খরচ গড়ে পাঁচ লাখ টাকা৷ ভারত, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল কোন দেশের প্রবাসীদের এত টাকা খরচ করে আসতে হয় না৷ অথচ অধিকাংশ বাংলাদেশি পাঁচ-সাত লাখ টাকা খরচ করেও দেশে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠাতে পারেন না৷এই কথার সত্যতা মেলে প্রবাসী আয়ের তথ্যে৷ মনিরের মতো ১৬ লাখ নতুন কর্মী গত তিনবছরে সৌদি আরবে এসেছেন৷ আর আগের কর্মী ধরলে নতুন পুরাতন মিলিয়ে দেশটিতে এখন ৩০ লাখ বাংলদেশি আছেন৷ বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ ও ২০২৩ সালে ২৪ লাখ লোকের বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে যার অর্ধেকই এসেছেন সৌদি আরবে৷ কর্মসংস্থানের এই রেকর্ড হলেও সৌদি আরব থেকে প্রবাসী আয় আসা ক্রমেই কমেছে৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তিনবছর আগে করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরেও সৌদি আরব থেকে ৫৭০ কোটি ডলার (৫.৭ বিলিয়ন) প্রবাসী আয় এসেছিল৷ এরপর ২০২১ সালে চার লাখ ৫৭ হাজার, ২০২২ সালে ছয় লাখ ১২ হাজার এবং ২০২৩ সালে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী দেশটিতে গিয়েছেন৷ সবমিলিয়ে তিন বছরে নতুন করে ১৬ লাখ কর্মী গেলেও প্রবাসী আয় না বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৭০ কোটি ডলার (৩.৭ বিলিয়ন) হয়েছে৷কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী আয় আসার দিক থেকে এতদিন সৌদি আরব শীর্ষে থাকলেও সেখান থেকে আয় কমায় ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে৷ অথচ ২০১৩ সাল থেকে গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে না দেশটি৷ অথচ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় এই শ্রমবাজারে ২০০৮ সালেও ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী গিয়েছিলেন৷ সর্বশেষ ২০১২ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন কর্মী দেশটিতে যায়৷ এরপর ২০১৩ সালে অক্টোবর থেকে দেশটিতে কর্মী যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়৷ গতকয়েক বছরে দেশটিতে লাখদুয়েক কর্মী গেছেন যার বড় একটি অংশ গেছে পর্যটক ভিসায়৷ ফলে তারাও নানা সংকটে আছেন৷ বারবার আলোচনা হলেও বন্ধ এই শ্রমবাজারটি পুরোপুরি চালু হয়নি৷একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ বাহরাইনেও ২০১৮ সাল থেকে কর্মী পাঠানো বন্ধ৷ অথচ ২০১৬ সালেও ৭২ হাজার কর্মী গেছেন৷ বন্ধের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ওমান৷ গতবছরের নভেম্বর থেকে দেশটি বাংলাদেশিদের নিচ্ছে না৷ ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ এক লাখ ৮৮ হাজার জন লোক যায় দেশটিতে৷ গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশীদের জন্য সব ধরনের ভিসা বন্ধের ঘোষণা দেয় ওমান সরকার৷রয়্যাল ওমান পুলিশের (আরওপি) পক্ষ থেকে বলা হয়, সব শ্রেণীর বাংলাদেশী নাগরিকদের নতুন ভিসা ইস্যু স্থগিত কার্যকর হবে৷ ওমানে টুরিস্ট ও ভিজিট ভিসায় আসা প্রবাসীদের ভিসা পরিবর্তন করার সুযোগও একই সাথে স্থগিত থাকবে৷ ওমানের পক্ষ থেকে এটি সাময়িক বলা হলেও কবে নাগাদ বাজারটি চালু হবে কেউ বলতে পারছে না৷ আবার বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই তৃতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজারটি কেন এবং কী কারণে এখনো বন্ধ হলো সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা নেই বাংলাাদেশের৷ জনশক্তি প্রেরনের সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, ওমানের শ্রমবাজারটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই বাজার খোলার ব্যাপারে সরকারের তৎপরতা চোখে পড়ছে না৷এরমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ নানা কারণে ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কিত অভিবাসন খাতের লোকজন৷ তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজার যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক কাজেই এখানকার বড় কোন শ্রমবাজার বন্ধ হলে পুরো শ্রমবাজারে তাঁর প্রভাব পড়েছে, ভবিষ্যতেও পড়বে৷ কাজেই দ্ষ কর্মী পাঠানো ও বিকল্প শ্রমবাজার গড়ে তোলা জরুরি৷কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমবাজার, প্রবাসী আয়ের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের এতো যোগসূত্রতা হলো কীভাবে? পেছনে ফিরলে দেখা যাবে, বিপুল পরিমান তেল আবিস্কারের পর ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে নতুন করে বড় ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল শীর্ষক জোটভুক্ত ছয়টি দেশ৷ ফলে তাদের বিপুল পরিমান প্রবাসী শ্রমিকের প্রয়োজন হয়৷ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি মুসলিম দেশ হিসেবে এখান থেকে কর্মী যাওয়া শুরু হয়৷ তেল ও খনিজ সম্পদ পেয়ে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি আর প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যাও বাড়তেই থাকে৷ প্রবাসীদের পাঠানো এই আয়ই পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে৷ বদলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি৷প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটির কাছে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে ছয় হাজার কর্মী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গিয়েছিল৷ এরমধ্যে আরব আমিরাতে দুই হাজার, কাতারে এক হাজার ২২১ জন, কুয়েতে ৬৪৩ জন, বাহরাইনে ৩৩৫ জন, সৌদি আরবে ২১৭ জন এবং ওমানে ১১৩ জন কর্মী গিয়েছিল৷এরপর প্রতি বছরে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক বিদেশে যেতে থাকেন৷ ১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো সেটি বছরে ৫০ হাজার ছাড়ায়৷ ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো বছরে এক লাখ কর্মীর বিদেশে যায়৷ এরপর সেটি দুই লাখ-তিন লাখ থেকে বাড়তে বাড়তে ২০০৭ সালে এক লাফে আট লাখে চলে যায়৷ ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে আট লাখ ৭৫ হাজার কর্মী বিদেশে গিয়েছিল৷ ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো সংখ্যাটি ১০ লাখ ছাড়ায় যার মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখই গিয়েছিল সৌদি আরবে৷বর্তমানে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন যার মধ্যে ৭৫ শতাংশই আছে জিসিসিভুক্ত ছয়টি দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েত ও বাহরাইনে৷ এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই আছেন লাখ ত্রিশেক বাংলাদেশি৷ এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছেন ১২ থেকে ১৫ লাখ বাংলাদেশি৷ এছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান ও বাহরাইনে গড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ করে বাংলাদেশি আছেন৷বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ থেকে যতো কর্মী বিদেশে গেছেন তার ৩৫ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে৷ এরপর ১৭ শতাংশ গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ১২ শতাংশ ওমানে, পাঁচ শতাংশ কাতারে, চার শতাংশ কুয়েতে এবং দুই শতাংশ বাহরাইনে৷ এর মানে মোট প্রবাসদের ৭৫ শতাংশ আছেন উপসাগরীয় ছয়টি দেশে৷ এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডান ও লেবাননেও অনেক বাংলাদেশি যাচ্ছেন যাদের অধিকাংশই নারী৷ মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর৷ বারবার বিকল্প শ্রমবাজারের কথা বলা হলেও মধ্যপ্রাচ্যই ভরসা বাংলাদেশের৷বাংলাদেশের শ্রমবাজার যেমন মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভরশীল তেমনি প্রবাসী আয়ের শীর্ষ দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যের৷ ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, ইতালি, কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান, বাহরাইন, ইতালি৷এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আরব আমিরাত থেকে ৩৬৭ কোটি ডলার, সৌদি আরব থেকে ৩২৮ কোটি ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৬৮ কোটি ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ২৫৩ কোটি ডলার, কুয়েত থেকে ১৫০ কোটি ডলার, ইতালি থেকে ১৩৩ কোটি, কাতার থেকে ১২৮ কোটি ডলার, মালয়েশিয়া থেকে ১২৬ কোটি ডলার, ওমান থেকে ৯২ কোটি ডলার এবং বাহরাইন থেকে ৫৪ কোটি ডলার এসেছে৷বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বছরভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে ২০২১ সালে৷ সে বছর মোট ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার পাঠান প্রবাসীরা৷ এরপর ২০২২ ও ২০২৩ সালে ২৪ লাখ নতুন কর্মী গেছেন বিদেশে৷ কিন্তু প্রবাসী আয় বাড়েনি৷ ২০২৩ সালে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৯১ কোটি ডলার৷ ২০২১ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৩ সালে প্রবাসী আয় কমেছে ১৬ কোটি ডলার৷কিন্তু কেন প্রবাসী আয় কমছে? প্রবাসীরা বলছেন, বাংলাদেশিরা মূলত নির্মাণশ্রমিক, প্লান্টেশেন, কৃষি, সার্ভিস বা উৎপাদন খাতে কাজ করেন৷ এদের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক৷ পাঁচ থেকে সাতলাখ টাকা খরচ করে তারা বিদেশে যান৷ পৃথিবীর আর কোন দেশ থেকে শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাওয়ার খরচ এতো বেশি নয়৷ এই খরচ না কমিয়ে অনেক বেশি লোক আসলে বাকিদেরও বেতন কমে৷ দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা পরিশ্রম করেও তখন দেশে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠানো সম্ভব হয় না৷
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ২০১৯ সালের তথ্যমতে, একজন ফিলিপিনো যেখানে মাসে ৫৪৬ ডলার দেশে পাঠান সেখানে প্রবাসী একজন বাংলাদেশি কর্মী মাসে গড়ে ২০৩ ডলারের প্রবাসী আয় পাঠান৷ অথচ অভিবাসন খরচ বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি৷ কিন্তু সেই তুলনায় আয় বাড়ছে না৷ আবার গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত, শ্রীলঙ্কা বা যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশিদের বিদেশে যাবার খরচ বেশি৷বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও প্রবাসী আয় শুধু মধ্যপ্রাচ্যেকেন্দ্রিক তাই নয়, সেখানে কোন সংকট হলে তাঁর প্রভাবও পড়ে সবচেয়ে বেশি৷ এই যেমন ২০০৯ সালে সৌদি আরবের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পর কর্মী পাঠানো অর্ধেকে নেমে আসে৷ ওই বছর মাত্র পৌনে পাঁচ লাখ কর্মী বিদেশে গিয়েছিল৷ পরের বছর ২০১০ সালে সেটি পৌনে চারলাখে নেমে আসে৷ এরপর ২০১৩ সালে আবার আরব আমিরাতের শ্রমবাজার বন্ধ হলে পরিস্থিতি অরো খারাপ হয়৷ তবে কাতার, ওমান ও বাহরাইন তখন বেশ বড় সংখ্যায় কর্মী নেওয়ায় শ্রমবাজার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি৷