সৌদি আরবে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং বাংলাদেশের করণীয়

সৌদি আরবে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং বাংলাদেশের করণীয়

রাশেদ আলম ভূঁইয়া

আর্থিক সচ্ছলতা ও পরিবারের জীবনমান উন্নয়নের প্রত্যাশা নিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ বাংলাদেশী কাজের জন্য বিদেশে যান। অভিবাসী শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন।আর্থিক সচ্ছলতা ও পরিবারের জীবনমান উন্নয়নের প্রত্যাশা নিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ বাংলাদেশী কাজের জন্য বিদেশে যান। অভিবাসী শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। তাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত আয় দেশে ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও লেনদেন ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এছাড়া গ্রামবাংলার আর্থসামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের জন্য অভিবাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশী শ্রমিকদের প্রধান গন্তব্যস্থল সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মালয়েশিয়া ও বাহরাইন। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশী মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবে কর্মরত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই সৌদি আরব বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য শীর্ষ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৩-২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সৌদি আরবে মোট ৪৭ দশমিক ৫৬ লাখ অভিবাসী শ্রমিক রফতানি করেছে, যা প্রায় অন্য ৩৪ দেশের শ্রমবাজারে জনশক্তি রফতানির সমান। এমনকি ২০২০ সালে মহামারীর মধ্যেও যখন বেশির ভাগ শ্রমবাজারই বন্ধ ছিল, সৌদি আরব তখন ১ দশমিক ৬১ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ করেছিল। উপসাগরীয় দেশটি তার ‘ভিশন-২০৩০’-এর অধীনে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা দেশটির শ্রমবাজারে বাংলাদেশীদের জন্য অধিকতর কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এমনকি নতুন মেগা প্রকল্পগুলোয় শ্রমিক জোগান দেয়ার জন্য সৌদি আরব আগামীতে বাংলাদেশ থেকে আরো কর্মী নিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে।পারস্পরিক বোঝাপড়া, গভীর ভ্রাতৃত্ববোধ এবং বহুপক্ষীয় খাতে সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশ সৌদি আরবের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে। বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে উভয় দেশের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, একই ধরনের ধর্মীয় মূল্যবোধ, এছাড়া বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের সহযোগিতা ও পারস্পরিক স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বহু বছর ধরে সৌদি আরব বাংলাদেশকে তার বিশ্বস্ত বন্ধুদের একটি হিসেবে মূল্যায়ন করে আসছে এবং সৌদি আরব বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় অংশীদার। দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা দুই দেশের সম্পর্কের গতিশীলতায় বিভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। দেশটি বাংলাদেশী কর্মীদের সবচেয়ে বড় নিয়োগকারী রাষ্ট্র। অভিবাসীরা উভয় দেশের অর্থনীতি ও জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বর্তমানে প্রায় তিন মিলিয়ন বাংলাদেশী সৌদি আরবে কাজ করছেন, যাদের বেশির ভাগই নির্মাণকাজ, পরিচ্ছন্নতা ও গৃহপরিচারিকা বা পরিষেবা খাতে নিয়োজিত। সৌদি আরবে অবস্থানরত বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকরা সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে বার্ষিক প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। এছাড়া অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আরো ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে।উল্লেখ্য ভিশন ২০৩০-এর অধীনে “গ্রিন সৌদি উদ্যোগ” এবং “ফিফা বিশ্বকাপ ২০৩৪” আয়োজনের মতো মেগা প্রকল্পগুলো সৌদি সরকার গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত এসা ইউসুফ এসা আল দুহাইলান এ প্রকল্পগুলোর কথা জানান এবং মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য আরো বেশি কর্মী, বিশেষ করে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে সৌদি সরকারের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেছেন।বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকরা পরিশ্রমী ও কর্মনিষ্ঠতার জন্য ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। এই নভেম্বরে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে নার্স নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছে যা বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এ ধরনের দক্ষ কাজে চাকরির সুযোগ তৈরি হলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ নিঃসন্দেহে গতিশীলতা পাবে। অধিকন্তু সৌদি আরব সম্প্রতি ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির চিত্তাকর্ষক মেগাসিটি নিওমের উন্নয়নের কথাও ঘোষণা করেছে যার খরচ হবে ৮০০ বিলিয়ন পাউন্ড।প্রকল্পটির লক্ষ্য মরুভূমির মাঝখানে একটি ৭৫ মাইল দীর্ঘ ভবিষ্যৎ শহর তৈরি করা যা পথচারী এবং সবুজায়নকে অগ্রাধিকার দেবে। সৌরচালিত জ্বালানি নিশ্চিতের মাধ্যমে শহরায়ণের পরিবেশগত প্রভাবকে কমিয়ে আনবে। এ ধরনের মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ শুরুর ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে সৌদি সরকার ২০২৫ সালে কর্মসংস্থানের বাজারে ঝড় তোলার জন্য প্রস্তুত। এ প্রকল্পগুলো বিশ্বজুড়ে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করবে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কতখানি প্রস্তুত এ শ্রমবাজারে নিজেদের দক্ষ শ্রমিক জোগান দেয়ার ক্ষেত্রে। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ব্যুরোকে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার ব্যাপারে জোরারোপ করার উদ্দেশ্যই কলামটি লেখা।বাংলাদেশ সৌদি সরকারের “ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত—এ বার্তা এখনই জানান দেয়া দরকার। এ প্রকল্পগুলোয় জনশক্তি, কৃষি এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে কারিগরি সহযোগিতা এবং বিবিধ শিল্প ও বাণিজ্যে লজিস্টিক সাপোর্ট সার্ভিসের মার্কেট কীভাবে ধরা যায় সে সম্পর্কিত দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া। এভাবে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।উপরিউক্ত সম্ভাবনাগুলোর আলোকে এখন আলোচনা করা দরকার, বর্তমান বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ে কী কী চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে এবং এ প্রকল্পগুলোয় বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার।উল্লেখ্য এর আগে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সৌদি আরব শীর্ষে অবস্থান করলেও বর্তমান অর্থবছরে আরব দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে।২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এর অবস্থান তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে সংযুক্ত আরব অমিরাত থেকে ৬৭০ দশমিক ৪ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫৩২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ও সৌদি আরব থেকে ৫১৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয় এসেছে। উল্লেখ্য ২০২২ সালে সৌদি আরব থেকে ৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ও ২০২৩ সালে ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। প্রত্যাশা অনুযায়ী, বর্তমানে সৌদি আরব থেকে আগের মতো রেমিট্যান্স প্রবাহ আসছে না। এর একটি কারণ হতে পারে, আগের মতো ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম আসছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, পেশাদার ও দক্ষ জনশক্তি রফতানির হার কমেছে। ফলে একটি বড় সংখ্যক শ্রমিক সৌদিতে কাজে গেলেও রেমিট্যান্স কম আসছে। সৌদির এ প্রকল্পগুলোয় দক্ষ শ্রমিক নিয়োগের জন্য বর্তমানে বিদেশে যেতে আগ্রহীদের মধ্য থেকে কর্মদক্ষতা অনুযায়ী শ্রমিকদের একটি ডাটাবেজ তৈরির কাজ এখন থেকে শুরু করতে হবে।এছাড়া অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় কতগুলো মৌলিক সমস্যার কথা সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। ভিসা সংগ্রহের ক্ষেত্রে দেশটিতে ভিসা ট্রেডিং একটি বড় সমস্যা। উভয় দেশে গড়ে ওঠা দালাল চক্র এভাবে জনশক্তি রফতানির খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বছর শেষে ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য শ্রমিকদের উচ্চ ইকামা ফি আরেকটি প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ আকামা ফি, ভিসা রিনিঊ করতে ব্যর্থ হওয়া এবং ক্রমবর্ধমান হারে অভিবাসী শ্রমিকরা দ্রুত দেশে ফেরার ফলে তাদের পরিবার এবং বাংলাদেশী শ্রম অভিবাসন স্টেকহোল্ডাররা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।আরেকটি গভীর উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, আরব দেশটিতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী শ্রমিকের মৃত্যুর খবর। বাংলাদেশী শ্রমিকরা কর্মনিষ্ঠতা ও পরিশ্রমী হিসেবে সুনাম পেলেও অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা কর্তৃক অবহেলা ও নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছেন—এটা প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসছে। সঠিক কর্মপরিবেশের অভাব ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা এবং সঠিক সময়ে স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ছোটখাটো অসুস্থতা বা রোগ বড় আকার ধারণ করছে এবং শ্রমিকরা মৃত্যুবরণ করছেন। শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং মেডিকেল সাপোর্ট টিম গঠন করতে হবে। আকামা ফি কমানো ও পুনর্নির্ধারণের জন্য সৌদি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া প্রবাসী শ্রমিকদের আইনি সহায়তা প্রদান করার জন্য দূতাবাসে লিগ্যাল উইং গঠন করা অতীব জরুরি।সামগ্রিকভাবে সৌদি শ্রমবাজারের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগগুলো ধরার জন্য জনশক্তি রফতানিতে সরকারের একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ করা উচিত। চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর মাধ্যমে কম জনশক্তি রফতানি করেও রেমিট্যান্স আয় বেশি উপার্জন করা যেতে পারে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য এখন থেকেই বাংলাদেশ সরকারকে অভিবাসীবান্ধব কূটনীতির ওপর রাষ্ট্রনীতিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে অন্যতম প্রধান অংশগ্রহণকারী হিসেবে বাংলাদেশ তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক গতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হবে।