যখন ইস্টারের আগমন ঘটে, তখন অধিকৃত ভূখণ্ডে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি খ্রিস্টানরা আনন্দোৎসবের পরিবর্তে উদযাপন করেন এই পবিত্র দিনটি নীরব প্রার্থনা আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। গাজার ওপর ইসরায়েলের লাগাতার নির্মম হামলা এবং পশ্চিম তীরে সামরিক তৎপরতার মধ্যেই ইস্টারের ঐতিহ্যবাহী উৎসব কার্যত বাতিল হয়ে গেছে; তার জায়গা নিয়েছে নিস্তব্ধ গির্জা প্রার্থনা ও প্রতিরোধের প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ।
রামাল্লায় গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের ফাদার এলিয়াস আওয়াদ আরবি সংবাদমাধ্যম আল-আরাবি আল-জাদিদ-এর কাছে বলেন, প্রতিবছরের মতো ইস্টারের আনন্দঘন প্রকাশ—যেমন শোভাযাত্রা, সংগীত, সজ্জা—এ বছর পরিত্যক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, “ফিলিস্তিন রক্তাক্ত। আমাদের মানুষ মরছে—শিশু আর নারী। এ বছর ইস্টার কেবল প্রার্থনা ও উপাসনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমরা শান্তির জন্য প্রার্থনা করি, বন্দিদের মুক্তির জন্য, এবং চাই যে ফিলিস্তিনিরা যেন স্বাধীনতা লাভ করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে।”
দ্বিতীয় বছরেও যুদ্ধের ছায়ায় ইস্টার পালন করছে ফিলিস্তিনের খ্রিস্টানরা। রামাল্লার সাংবাদিক হিন্দ শ্রেইদেহ একে বর্ণনা করেছেন “এক দীর্ঘ মহাপবিত্র সপ্তাহ হিসেবে, যা টানা আঠারো মাস ধরে চলছে—এক প্রকার প্রতিদিনের শূলবিদ্ধতা, যার কোনো বিরতি নেই।”
তিনি উল্লেখ করেন, খ্রিস্টধর্মের পবিত্রতম স্থান জেরুজালেমের চার্চ অব দ্য হোলি সেপালখারে প্রবেশাধিকারও এখন অনেকের জন্য কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে, ইসরায়েলের পারমিট নিয়ম এবং চেকপয়েন্ট ব্যবস্থার কারণে।
“ওখানে পৌঁছানো এখন এক অসম্ভব সৌভাগ্যের বিষয়,” তিনি বলেন।
গাজায়, যেখানে গির্জা ও মসজিদ সমানভাবে বোমাবর্ষণের শিকার, সেখানকার খ্রিস্টানরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও সাহসিকতার সঙ্গে গত সপ্তাহে পালন করেছেন পালম সানডে।
“আমাদের পুনরুত্থান কেবল অতীতের কোনো স্মৃতি নয়। এটা প্রতিদিনের প্রতিরোধের কাজ,” বলেন হিন্দ শ্রেইদেহ। “আস্থা—এই বিশ্বাসই আমাদের অন্ধকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র।”
রামাল্লার কাছে আবউদ শহরের বাসিন্দা সুলেইমান আনফুসও তাঁর এই বক্তব্যে সায় দেন। “আমাদের গাজার ভাইবোনদের নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে—এই পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে উৎসব করব?” তিনি প্রশ্ন তোলেন। “এটা আমাদের স্বভাব নয়, আমাদের পরিচয় নয়।”
যখন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নীরবে চলছে, তখন জনসমক্ষে কোনো উৎসবের আয়োজন করা হয়নি। “ইস্টার হল আশার প্রতীক, অন্ধকারের ওপর বিজয়ের প্রতীক,” তিনি বলেন। “আমরা মূল ঐতিহ্যগুলো ধরে রাখি, বিশেষ করে শিশুদের জন্য—তাদের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে, আমাদের পরিচয় টিকিয়ে রাখতে।”
বেথলেহেমে শিল্পী মাসআদাহ হমেইদ পবিত্র আগুনের ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রায় অংশ নেন যিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান ন্যাটিভিটি চার্চে, কিন্তু বলেন যে এবারে উৎসবের আনন্দ নেই।
“এবারের ইস্টার এসেছে আলো ও বিশ্বাস নিয়ে, কিন্তু আনন্দহীনভাবে,” তিনি বলেন। ঘরে বসে তিনি এখনো তৈরি করছেন ইস্টারের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি—মামউল এবং রঙিন ডিম, কিন্তু তাঁর হৃদয় ভারাক্রান্ত গাজার মানুষের দুঃখে। “এ বছরের দুঃখ আমাদের ভেতরেই বাস করছে,” তিনি বলেন, এবং বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান যুদ্ধ বন্ধ করার।
উত্তর পশ্চিম তীরের জাবাবদেহ শহরেও ইস্টারের উৎসব সীমিত করে আয়োজন করা হয়েছে। “ঈদের সময় আমাদের মুসলিম ভাইবোনদের যন্ত্রণা আমরাও অনুভব করি, যখন আমাদের মানুষ মারা যায়, আহত হয়, আর বন্দি হয়,” বললেন জোসেফ ল্যামব্রোস। “গত বছরের মতো এই বছরও আনন্দের কোনো জায়গা নেই।”
সাধারণত যে সব মিষ্টান্ন তৈরি হয়, সেগুলোর প্রস্তুতিও এবার চলছে নিঃশব্দে। “আমরা শুধু ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করি। এই নিষ্ঠুর হামলার মুখে তিনি-ই একমাত্র আশ্রয়।”
জাবাবদেহর মেয়র ঘাসসান দ্রাইবেস নিশ্চিত করেন যে সব ধরনের জনউৎসব বাতিল করা হয়েছে। “খ্রিস্টানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উৎসব ইস্টার এখন কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ,” তিনি বলেন।
যে শহর একসময় শোভাযাত্রা করত, পবিত্র আগুনকে গ্রহণ করত উৎসবমুখর পরিবেশে—সেই শহর আজ সম্পূর্ণরূপে আত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করেছে। “এইভাবেই আমরা আমাদের বাস্তবতাকে প্রকাশ করি—নিধন আর ধ্বংসের অভিযানের মধ্যেকার আমাদের সত্যকে,” তিনি বলেন। জাবাবদেহ শহর বর্তমানে জেনিন থেকে বাস্তুচ্যুত প্রায় ১,০০০ ফিলিস্তিনিকে আশ্রয় দিচ্ছে, যারা ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের শিকার।
জেরুজালেম, যা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ খ্রিস্টানের কাছে ইস্টারের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, সেখানেও আবহাওয়া একইভাবে নিরুত্তাপ। “ইস্টারের সব আনন্দ যেন হারিয়ে গেছে,” বললেন স্থানীয় সমাজকর্মী জর্জ সাহার। “গির্জাগুলো যৌথভাবে ঘোষণা করেছে, ধর্মীয় আচার ছাড়া অন্য সব উৎসব—স্কাউটদের শোভাযাত্রা, সংগীত, সজ্জা—বাতিল করা হয়েছে।” এমনকি শিশুদের জন্যও সব কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে শুধুই গৃহপরিসরে।
জেরুজালেমের ওল্ড সিটির বাসিন্দা তিন সন্তানের মা এলিয়া ইয়াকুব জানান, তাদের পরিবার ইস্টারের ঐতিহ্যগুলোকে এবার ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। “শুধু শিশুদের জন্য কিছু খেজুরের কুকি বানিয়েছি, কিন্তু সেগুলো অতিথিদের ট্রেতে দেয়া হবে না,” তিনি বলেন। “গাজা থেকে আসা ভিডিও আর ছবি ভয়াবহ। শিশুরাও তা বোঝে। আমরা যখন বলি যে গাজার কারণে এবারে কোনো রীতি পালন করা হবে না, ওরা তা নিঃশব্দে মেনে নেয়।”
তাঁর পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে সান্দ্রা জানতে চেয়েছিল, তারা কি এবারও আগের মতো স্কাউট শোভাযাত্রা দেখতে বাইরে যাবে না, অথবা সাজগোজ করে কোথাও খেতে যাবে না। “আমি বলেছিলাম, এ বছরও কোনো শোভাযাত্রা হবে না, কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়াও নয়। গাজা এখন অনাহারে কষ্ট পাচ্ছে, মৃত্যুর মুখে।” ছোট্ট মেয়েটি নীরবে মাথা নেড়ে আবার ভাইবোনদের সঙ্গে ইস্টারের ডিম রাঙাতে লেগে যায়
জেরুজালেমেরই বাসিন্দা ইয়ারা দাউদ ইস্টারের গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য নিয়ে বলেন, “আমাদের কাছে ইস্টারই বছরের সত্যিকারের সূচনা, জানুয়ারির এক তারিখ নয়।” এ বছর একটি ব্যতিক্রমী মুহূর্ত—সব খ্রিস্টান গোষ্ঠী একই দিনে ইস্টার পালন করছে। কিন্তু এই মিলনমুহূর্তেও বিষাদের ছায়া।
“পশ্চিম তীর থেকে খ্রিস্টানরা পারমিট না-পাওয়ায় আসতে পারছেন না, আর বিদেশ থেকেও অনেকেই বাধাপ্রাপ্ত,” তিনি যোগ করেন।
তাঁর পরিবারে, অনেকের মতোই, উৎসবের প্রস্তুতি হয়েছে একেবারে সামান্য। “গাজা যখন অনাহারে, তখন কীভাবে আমরা কুকি বানাব?” তিনি প্রশ্ন তোলেন। শিশুদের জন্য নির্ধারিত ডিম রাঙানোর অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে, আর অনেকেই মনে করেন উৎসব করা লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। “এ যেন যুদ্ধ আমাদের আলো নিভিয়ে দিয়েছে,” তিনি বলেন।
শেষে দাউদ একটি বড় ছবি তুলে ধরেন: “ইসরায়েল সবসময় চেষ্টা করেছে ইস্টারের সময় খ্রিস্টানদের উপস্থিতি দমন করতে, কারণ তারা একে মনে করে একটি সত্যিকারের ফিলিস্তিনি পরিচয়—যা তাদের বর্ণনার সঙ্গে যায় না,” তিনি বলেন।
“কিন্তু জেরুজালেমে ইস্টার আজও একটি শক্তিশালী প্রতীক—ফিলিস্তিনি পরিচয়ের প্রতীক, যার মধ্যে এক আরব আত্মা আছে, আর সেই আত্মাই ইসরায়েলকে অস্বস্তিতে ফেলে।”