নয় মৃত্যুদণ্ড দেখেছেন, ভারি দিনগুলো প্রেমে ভরেছেন- নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত

User avatar placeholder
Written by piash2004

May 27, 2025


হুড তাঁর পকেট থেকে অভিষেকের তেল বার করলেন, শেষ আশীর্বাদ দেবেন বলে। চারপাশে মৃত্যুর নিঃশব্দতা। তার মাঝেও লিটলজন একটু হাসির সুর ছুঁড়ে দিলেন—“জেফ, আমার জন্য ব্লান্ট এনেছ?” তারপর হঠাৎই গম্ভীর হয়ে লিটলজন বলে উঠলেন, “আমি ভালো আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।” তারপর উপস্থিত মা ও মেয়েকে ভালোবাসা জানান।

হুড তখন বললেন, “ক্ষমা করে দিস। তোকে বাঁচাতে পারলাম না বলে দুঃখ হয় খুব।”

লিটলজন, যিনি শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালে ওকলাহোমা সিটির এক দোকানমালিক কেনেথ মিয়ার্সকে হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে গেছেন, তখন উল্টে হুডকেই সান্ত্বনা দিলেন—“জেফ, তুই না থাকলে এতদূর আসতেই পারতাম না।”
বিদায়ের মুহূর্তে হুড বললেন, “ভালোবাসার দিকে এগিয়ে যা।”

জীবনের শেষ প্রান্তে বন্ধু হয়ে ওঠা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহারে মৃত্যুদণ্ড (২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কেনেথ স্মিথের মৃত্যু) সহ মোট নয়জনের মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন জেফ হুড।

“আমার কাজ শুরু হয় যখন ওদের জীবনের শেষ তিন থেকে ছয় মাস বাকি। আমি সেই সময়টা ওদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠি,” ২০২৪ সালে ডেভিড হোসিয়ারের মৃত্যুর পরে USA TODAY-কে বলেছিলেন হুড। “যাতে মৃত্যুর মুহূর্তেও আমি ওদের সবচেয়ে কাছেরজন হয়ে থাকতে পারি।”

এই গভীর, নিঃস্বার্থ সঙ্গের জন্যই ক্যালিফোর্নিয়ার পেপারডাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড লেমলি তাঁকে ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন।

“জেফ এমন সব মানুষের পাশে দাঁড়ান, যাদের সমাজ প্রায় ভুলে গেছে,” বলেন লেমলি। “শান্তির জন্যই শান্তি, ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসা। এমন কাজ পুরস্কারের যোগ্য।”

হুড নিজে বলেন, তাঁর প্রাপ্তি হলো, “যাদের আমরা সমাজে উপেক্ষা করি, তাদের জীবনে এবং জীবনের অন্তিম সময়েও ঈশ্বরের ভালোবাসা প্রবাহিত হতে দেখা।”

৩৩৮ জন মনোনীতের তালিকায় এক যাজক
নোবেল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শান্তি পুরস্কারের জন্য ৩৩৮ জন প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন। তাঁদের নাম ৫০ বছর পর্যন্ত গোপন রাখা হবে।

লেমলির মনোনয়নপত্রে শান্তির নতুন এক সংজ্ঞার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে—যেখানে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মতো প্রচেষ্টার (২০২৪ সালের বিজয়ী নিহন হিদানকিয়ো) পাশাপাশি সমাজে প্রান্তিকদের মর্যাদা রক্ষা করাও শান্তি রচনার পথ বলে মনে করা হয়েছে।

“আমি মনে করি, জেফ হুডের জীবন ও কাজ—একজন মানুষের হৃদয় থেকে আরেকজন মানুষের হৃদয়ে যে শান্তি বয়ে যায়, তারই নিদর্শন,” লেমলি লিখেছেন তাঁর চিঠিতে।
পুরস্কারের ফলাফল প্রকাশিত হবে অক্টোবর মাসে।

মৃত্যুকক্ষে যাজকের উপস্থিতি
২০২২ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় আসামির ধর্মীয় পরামর্শদাতাকে উপস্থিত থাকতে দিতে হবে। সেই থেকে হুড তাঁর মিশনের অংশ হিসেবে এই মৃত্যুকক্ষগুলোতে যাওয়া শুরু করেন।

আর্কানসাসের লিটল রকে বসবাসকারী, পাঁচ সন্তানের বাবা ৪১ বছরের এই যাজক এখন দেশজুড়ে নানা জায়গায় ছুটে বেড়ান।

এই মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যাঁদের সঙ্গে তিনি রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দুইজন—আলাবামার গ্রেগরি হান্ট ও ফ্লোরিডার অ্যান্থনি ওয়েনরাইট—আগামী ১০ জুন ফাঁসির অপেক্ষায়।

লেমলি বলেন, “এরা এমন মানুষ, যাদের জীবনের শেষ মুহূর্তে জেফ পাশে থাকেন। ওদের আর সমাজে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, সংস্কার করাও নয়। কিন্তু জেফ ওদের সেই ভয়াবহ মুহূর্তে শান্তি দিতে পারেন। এটাই বড় কথা।”

শুধু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নয়, পরিবারও পাশে পান তাঁকে
হুড শুধু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সঙ্গেই থাকেন না, তাঁদের পরিবারকেও সাহচর্য দেন।

২০২৪ সালে যাঁর স্বামী স্টিভেন নেলসনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সেই নোয়া ডুবোয়া বলেন, মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে হুডের উপস্থিতি তাঁদের জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ।
“যখন কেউ জানে তার মৃত্যুর তারিখ নির্ধারিত, তখন হাজারটা প্রশ্ন মাথায় আসে,” বলেন ডুবোয়া। “‘আমি কি ভালো মানুষ? আমি কি মুক্তি পেতে পারি? স্বর্গ-নরক সত্যিই আছে?’—এসব প্রশ্নের উত্তর জেফ দিয়েছিলেন। অথবা এমনভাবে পথ দেখিয়েছিলেন, যাতে স্টিভেন শান্তি খুঁজে পায়।”

আজও ডুবোয়া ও হুডের মধ্যে বন্ধন অটুট। “আমরা একসঙ্গে পুরো বিষয়টা মোকাবিলা করেছি। একে অপরকে সামলেছি, আর সেই জায়গা থেকেই গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।”

চোখের সামনে মৃত্যু, হৃদয়ে ক্ষত
এম্যানুয়েল লিটলজনের মা সেলি ম্যাসন দেখেছেন, তার ছেলের মৃত্যুর পরে হুড কতটা ভেঙে পড়েছিলেন।

“আমি জেফকে দেখেছি—কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। অনেক যাজক আছেন, যাঁরা এতবার মৃত্যুদণ্ড দেখেছেন যে আর কিছু অনুভব করেন না। কিন্তু জেফ তা পারেনি। ও কাঁদছিল—সহ্য হচ্ছিল না,” বলেন ম্যাসন।

হুডই পরে লিটলজনের ‘সেলিব্রেশন অব লাইফ’-এর অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আজ তিনি ম্যাসনের পরিবারের এক সদস্যের মতো।

“আমি ওকে বলি, ‘জেফ, ঈশ্বর তোমার কাঁধে একটা বোঝা তুলে দিয়েছেন।’ আমি পারতাম না এই কাজ। কিন্তু জেফ পারছে। সে প্রতিটি মানুষকে জায়গা দেয় নিজের হৃদয়ে—ওরা দোষী হোক বা নির্দোষ, তাতে কিছু যায় আসে না। জেফ শুধু ভালোবাসা দেয়।”

কষ্টের কাজ, নিঃশব্দের শক্তি
লেমলি বলেন, জেফ হুডের এই কাজ কোনও সেলিব্রিটি-জীবন নয়, এটা একটা কষ্টের জীবন। আর ঠিক সে কারণেই এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

“তুমি যদি এমন একজনের পাশে দাঁড়াতে পারো, যে জীবনে ভুল করেছে, কিন্তু মৃত্যুক্ষণে তাকেও শান্তি দিতে পারো—তাহলে সেটা শুধু একজন মানুষের নয়, গোটা সমাজের প্রতি বার্তা হয়ে ওঠে,” বলেন লেমলি।

“মানুষ যেন দেখে—যুদ্ধের কী মূল্য, অভিবাসন নীতির কী মূল্য, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের মানবিক মূল্য কতটা গভীর। এই কাজ বলছে, কেউই ‘কম মানুষ’ নয়।”

জেফ হুড

Image placeholder

Leave a Comment