দখলদার ইসরায়েলি বসতকারীদের হাতে নরক হয়ে উঠেছে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি জীবন

User avatar placeholder
Written by piash2004

May 2, 2025

ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে, যেন তারা এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। শুধু মার্চ মাসেই ইসরায়েলি বসতকারীরা ২৫৫টি আক্রমণ চালিয়েছে। ফিলিস্তিনি সম্পত্তিতে ২২৪টি ধ্বংসযজ্ঞ চলে।

দখলদার পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতকারীদের সশস্ত্র দল একের পর এক হামলা চালাচ্ছে ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরে। অনেক সময়ই তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ছায়া-সুরক্ষায় এই হামলা চালায়। সম্প্রতি এসব আক্রমণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বসতিগুলোর নতুন চৌকি স্থাপন, বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, সম্পত্তি ধ্বংস এবং ফিলিস্তিনিদের শারীরিকভাবে আঘাত করা—সব মিলিয়ে দখল প্রক্রিয়া যেন আরও জোরদার হয়েছে।

গত শনিবার সকালে, রামাল্লার উত্তরে কুবার শহরে, নিজের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ছিলেন ৫৩ বছর বয়সী আদনান আমিরিয়া। হঠাৎই সশস্ত্র ইসরায়েলি বসতকারীদের একটি দল তার পাড়ায় হানা দেয়। তিনি বারান্দায় গিয়ে দেখেন, তার ৩৩ বছর বয়সী ভাতিজা মোহাম্মদকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা। নিচে নেমে রক্ষা করতে গেলে তাকেও ধরে ফেলে এবং নির্মমভাবে মারধর করে অপহরণ করে।

“ওরা আমাদের এক নতুন বসতি চৌকির কাছে নিয়ে গেল, যেটা ওরা কুবার শহরের জমিতে জোর করে তৈরি করেছে। আমাদের জামা খুলে, চোখ বেঁধে, আমাদের ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল। ওদের কেউ রাইফেল দিয়ে মারল, কেউ লাঠি দিয়ে, কেউ বা জুতা দিয়ে। সঙ্গে চলল অশ্রাব্য গালিগালাজ,”— দ্য নিউ অ্যারাব-কে জানান আমিরিয়া।

দলের একজন বসতকারী সেনা পোশাকে ছিল। আশপাশে ইসরায়েলি সেনার উপস্থিতিও ছিল, কিন্তু তারা কিছুই করল না—শুধু দেখল।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ধরে চলে নির্যাতন। পরে আমিরিয়াকে শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মোহাম্মদকে তখনও আটকে রাখে তারা।

“আমি ভেবেছিলাম, ওরা আমাদের গুলি করে ফেলে রেখে যাবে। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিল, যদিও মারধর থামেনি এক মুহূর্তও। পরে মোহাম্মদকেও ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে অনেক দূরে এক অচেনা জায়গায়,”—বলছিলেন তিনি।

দুজনকেই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। এখনো আতঙ্কে দিন কাটছে—আবার কখন হানা দেবে সন্ত্রাসীরা, কে জানে।

গত দুই সপ্তাহে এই এলাকায় বসতকারীদের ধারাবাহিক আক্রমণের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—ফিলিস্তিনিদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলো, যেন তারা এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

“আমরা মরব, তবু আমাদের ঘর ছাড়ব না। কোথায় যাব? তারা যদি ভাবে তাদের আক্রমণে আমরা ভয়ে পালাব, তবে তারা ভুল ভাবছে,”—স্পষ্ট ঘোষণা আমিরিয়ার।

সহিংসতার ঊর্ধ্বগতি

ফিলিস্তিনের ‘প্রাচীর ও বসতি প্রতিরোধ কমিশন’-এর প্রধান মু’আয়্যাদ শা’বান ৯ এপ্রিল এক বিবৃতিতে জানান, শুধু মার্চ মাসেই ইসরায়েলি বসতকারীরা ২৫৫টি আক্রমণ চালিয়েছে।

এসব আক্রমণের মধ্যে ছিল সশস্ত্র হামলা, জমি দখল, গাছপালা উপড়ে ফেলা ও ফিলিস্তিনিদের সম্পত্তি লুট। সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে হেবরন (৭১টি), নাবলুস (৪২টি), রামাল্লা (৩১টি), ও সালফিত (২৮টি) শহরে।

এছাড়াও ফিলিস্তিনি সম্পত্তিতে তারা ২২৪টি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, যার ফলে বিশাল এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নাবলুসে ৯২৫টি, সালফিতে ৩০৯টি, ও হেবরনে ১২০টি অলিভ গাছ সহ মোট ১,৩৫৪টি গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে।

গত মার্চ মাস থেকেই তারা ছয়টি নতুন অবৈধ চৌকি স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই কৃষিভিত্তিক বা পশুপালন কেন্দ্রিক। এর মধ্যে নাবলুসে চারটি, জেরিকো, রামাল্লা ও তুবাসে একটি করে চৌকি স্থাপনের চেষ্টা হয়েছে।

শা’বানের বিবৃতিতে বলা হয়, “বসতি স্থাপনের এই তীব্র গতি ফিলিস্তিনি ভৌগোলিক কাঠামোকে টুকরো টুকরো করে ফেলার ষড়যন্ত্র। বসতকারীরা মাটি দখলের মাধ্যমে বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করে, পরে সরকারিভাবে তা আইনসিদ্ধ করা হয়—এরই নাম উপনিবেশ।”

উম সাফার বিভীষিকা

রামাল্লার উত্তরে উম সাফা গ্রামে কিছুদিন আগে ইসরায়েলি বসতকারীরা আল-রাস পাহাড়ের চূড়ায় ইসরায়েলি পতাকা উড়িয়েছে—যে এলাকা তারা সম্প্রতি জোরপূর্বক দখল করেছে।

গ্রামটি এখন চারপাশ থেকে সেনাবাহিনী, ব্যারিকেড, লোহার গেট এবং মাটি বাঁধ দিয়ে ঘেরা। গ্রামে হামলা, ভ্রাম্যমাণ ঘর নির্মাণ, ও পাহাড়ি পথে নতুন সড়ক বানানোর মধ্যে দিয়ে চৌকির অবস্থান পাকাপোক্ত করা হচ্ছে।

গ্রাম পরিষদের প্রধান মারওয়ান সাবাহ দ্য নিউ অ্যারাব-কে বলেন, “পতাকা ওড়ানো মানে এই অবৈধ চৌকিকে ‘স্বীকৃতি’ দেওয়ার চেষ্টা। এর অর্থ হলো আমাদের গ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।”

তিনি আরও বলেন, “উম সাফার অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিন আমাদের জমি দখল করা হচ্ছে, গাছ কাটা হচ্ছে, এবং চূড়ায় বসতি বানানোর সঙ্গে সঙ্গে ভ্যালির দিক থেকেও গ্রামকে চেপে ধরা হচ্ছে। আমরা যেন নিজেদের গ্রামেই বন্দি।”

“এই পরিকল্পনা স্পষ্ট—গ্রামের মানুষদের তাড়িয়ে দেওয়া। আর তা ঘটছে আন্তর্জাতিক সমাজের ভীতি জাগানো নীরবতা দেখে,”—যোগ করেন তিনি।

মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পশ্চিম তীর

জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সংস্থা (OCHA) তাদের সর্বশেষ সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রামাল্লার কাছে বসতকারীদের সহিংসতায় তিনটি পরিবার, মোট নয়জন ফিলিস্তিনি গৃহহীন হয়ে পড়েছে।

সংস্থাটি বলেছে, “বসতিস্থাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবিক সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। ২০২৫ সালেই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ১৫,০০০-এর বেশি ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে, যা আরও জোরালোভাবে চাপ সৃষ্টি করে এবং ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বিতাড়নের ঝুঁকি বাড়ায়।”

১৫ থেকে ২১ এপ্রিলের মধ্যে OCHA নথিভুক্ত করেছে ২৩টি বসতকারী হামলা, যার ফলে একজন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ২৪ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ছয়জন ইসরায়েলি বসতকারীদের দ্বারা লোহার রড, মরিচ স্প্রে, গুলি কিংবা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সূত্র দা নিউ আরব

Image placeholder

Leave a Comment