কিয়েভের এক পার্কে, শীতদিনে তাদের প্রথম দেখা। কিশোরী মেয়েটি নেল আর্টিস্ট। ছেলেটি খাবার ডেলিভারি করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মতো, তাদেরও স্বপ্ন ছিল বড়—একজন ডাক্তার হবে, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার।
তবে তার আগে, বিয়ে। এই গ্রীষ্মেই মেয়েটির জন্মদিনে চমক হিসেবে প্রস্তাব দেবে, সতেরো বছরের দানিলো খুদিয়া বলেছিল আলিওনা জাভাডস্কার মাকে। তারা চেয়েছিল মেয়ের আঠারো হলেই বিয়ে করবে।
তাদের প্রেমের পাগলামো বাবা-মায়েদের বিস্মিতই করেছিল। কিন্তু পরে তাঁরা মেনে নেন।
জাভাডস্কার মা অকসানা বলেন, “আমরা জানতাম ওরা এখনও বাচ্চা, কিন্তু বুঝতে পারতাম ওরা নিজেরা নিজেদের সামলাতে পারবে।”
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ চারদিকে উত্তাল হলেও, খুদিয়া বলত—আলিওনার পাশে থাকলে তার মনে শান্তি নেমে আসে। সে তাকে ডাকত “আমার ছোট্ট মেয়েটা।” আলিওনা বলত—“আমার ছেলেটা।”
খুদিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দানিলো বন্ডারচুক বলেছিল, তার কাছে যখন প্রথম আলিওনার কথা বলেছিল, খুদিয়ার চোখ ঝলমল করছিল। “আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রেমিকা,” বলেছিল সে।
তারা ছিল অবিচ্ছিন্ন জুটি। আলিওনা খুদিয়ার বাস্কেটবল খেলা দেখতে যেত। সে যখন ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে চাইত, আলিওনা পাশে থেকে উৎসাহ দিত।
খুদিয়াকে সে পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও সাহায্য করেছিল। এমনকি যখন খুদিয়া এক প্রতারণামূলক ব্যবসায় আর্থিকভাবে ঠকেছিল, তখনও পাশে ছিল।
আলিওনা যখন ট্যাটু আঁকার প্রতি আগ্রহ দেখায়, খুদিয়া নিজেকে পরীক্ষার মডেল হিসেবে হাজির করে। সে আলিওনার হাতে নিজের গায়ে ট্যাটু করিয়েছিল—এলিয়েন, বিচ্ছু, চাঁদের ছবি।
আলিওনাও নিজের মনের দরজা খুলে দেয়। সে খুদিয়াকে জানিয়েছিল তার ইটিং ডিসঅর্ডার বা খাবার নিয়ে এলার্জির কথা। খুদিয়া তাকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে।
আলিওনার মা বলেন, “সে নিজেকে সুন্দর ভাবত না। খুদিয়াই তাকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে সে সত্যিই সুন্দর।”
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যখন যুক্তরাষ্ট্র শান্তি আলোচনা ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছিল, তখন এই প্রেমিক-প্রেমিকা কিয়েভে একটি ফ্ল্যাট খুঁজে পায়। আলিওনার মা-বাবার বাসা থেকে মাত্র কিছুদূরে। তারা যৌথ অ্যাকাউন্ট খুলেছিল, নতুন জীবনের প্রস্তুতি!
তবে যুদ্ধ থেকে পালানো যায়নি।
ছয় মাস আগে, এক রাতে আলিওনা স্বপ্ন দেখে—খুদিয়ার বাড়িতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। অদ্ভুত ছিল স্বপ্নটা, কিন্তু ধীরে ধীরে দৃশ্যগুলো ভুলে যায়।
গত বৃহস্পতিবার রাতে আলিওনার মনে অশুভ এক অনুভূতি জাগে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনি কেন। সে খুদিয়াকে মনে মনে জড়িয়ে ধরেছিল দশ মিনিট ধরে। বলেছিল, প্রতি ঘণ্টায় একবার করে আপডেট দিতে, যতক্ষণ না ঘুমায়।
রাত একটা—এয়ার সাইরেন বেজে ওঠে। সে খুদিয়াকে টেক্সট করে জানতে চায়—সব ঠিক আছে তো? কোনো জবাব আসেনি। পাশের বেসমেন্টে সাইরেন পার করে দেয়।
ভোরবেলা খুদিয়ার বন্ধু ফোন করে জানায়—রুশ ক্ষেপণাস্ত্র খুদিয়ার বাড়িতে আঘাত হেনেছে। ঘটনাস্থলেই মারা গেছে খুদিয়া। তার বাবা-মাও আর বেঁচে নেই। একমাত্র বোন ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার হয়েছে।
সেই এলাকায় কোনো দৃশ্যমান সামরিক লক্ষ্যবস্তু ছিল না। কাছেই ছিল সামরিক নিবন্ধন ও তালিকা অফিস, কিন্তু তা রাতে সাধারণত ফাঁকাই থাকে। শহরের নানা প্রান্তে গোপন অস্ত্র কারখানা বা অন্য টার্গেট থাকতে পারে, কিন্তু রুশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রায়শই নিখুঁত হয় না।
এ হামলায় মোট ১৩ জন নিহত হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত বিরলভাবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বলেছিলেন, “গুলিবর্ষণ বন্ধ করো, বসো, চুক্তি করো।”
গত সোমবার, খুদিয়ার অন্ত্যেষ্টিতে আলিওনা শেষবারের মতো বিদায় জানায়।
খুদিয়ার কফিনের সামনে হাঁটু গেড়ে কাঁপতে থাকে আলিওনা, কান্নায় ভেঙে পড়ে। উপস্থিত জনতা তাকে সরিয়ে নেয়। মা তাকে ধরে রাখে, যেন সে পড়ে না যায়। খুদিয়ার কফিন ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়।
“ওই ছেলেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিস,” বলে আলিওনা।
এই প্রথমবার, দুই পরিবারের দেখা হয়ে যায়। খুদিয়ার দিদিমা ছবি দেখে, যেটিতে মেয়েটি খুদিয়ার প্রতিকৃতির পাশে হাত রাখে। চিনে যান—
“তুমি আলিওনা, তাই না?” তিনি ডাকেন।
মৃত্যুর পরদিন থেকে, খুদিয়া স্বপ্নে আসে। কান্নায় ভেঙে পড়ে তার পায়ের কাছে। ঘুম আর আসে না আলিওনার। তার মা বলেন—“সে এখন ঘুমকে ভয় পায়।”
একটি পার্কের গাজেবোতে বসে থাকে মেয়েটি—যেখানে তারা একসাথে সময় কাটাতো। তার হাতে মোবাইল, পুরনো ছবিগুলো দেখে। একটি ছবিতে, তারা চুম্বন করছে। আলিওনার লম্বা চকচকে চুল খুদিয়ার মুখ ঢেকে দিয়েছে।
এখন তার কণ্ঠস্বর পাতাঝরা শব্দের চেয়েও নিচু। বলে, তার একটি অংশ চলে গেছে। মা দুশ্চিন্তায়—মেয়েটি হয়তো শোক সামলাতে পারবে না।
আলিওনা বলে, “ওর জড়ানোটা এত উষ্ণ ছিল।”
“আমরা গ্রীষ্মের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কত পরিকল্পনা ছিল আমাদের।”
(বার্তা সংস্থা এ পির প্রতিবেদন অনুবাদ)L
April 30, 2025