লন্ডনের রয়্যাল ফেস্টিভ্যাল হলে এক ব্যস্ত শনিবার বিকেলে, আমি নারীদের টয়লেটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম।

হঠাৎই এক পুরুষ চিৎকার করে বলল, ‘পুরুষদের টয়লেট তো এই পাশে!’
প্রথমে আমি তা উপেক্ষা করি। টয়লেট দুটি দু’টি লিফটের দুই পাশে, কয়েক মিটার দূরত্বে। আশেপাশে প্রচুর মানুষ।
কিন্তু সে বারবার বলতে লাগল, ‘পুরুষদের টয়লেট তো এই দিকে!’ আমি ভেবেছিলাম, কেউ নিশ্চয়ই বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে রসিকতা করছে। কিন্তু তখনই আমার কাঁধে একটি টোকা লাগল।
পেছন ফিরে দেখি, প্রায় ৬০-এর ঘরের এক লম্বা পুরুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি নারীদের সারির মধ্যে ঢুকে আমার গায়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘আপনি কি জানেন এটা নারীদের টয়লেট?’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি পেছন ঘুরে না তাকালে তিনি তো আমার মুখও দেখতে পেতেন না। তাহলে কী দেখে তিনি এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন? আমার স্কিন-ফেড চুল? কালো হুডি? না কি আমার উচ্চতা? আমি ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, যা সামান্য উঁচু হতে পারে, তবে বিশেষ কিছু নয়।
আমার সামনে ও পেছনে নারীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল আমি নিজের জায়গায় আছি। তদুপরি, যেখানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে নারীদের টয়লেট, প্রতিবন্ধীদের ব্যবহারযোগ্য, শিশু পাল্টানোর জায়গা এবং ইনক্লুসিভ টয়লেটের সাইন লাগানো ছিল।
তার ভঙ্গি ছিল আগ্রাসী। আমি স্তম্ভিত। আমি সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার কী মনে হয়? আমি কোন লিঙ্গের?’
সে অপ্রস্তুত হয়ে বলল, সে জানে না।
তখন আমি বললাম, ‘আপনি কি আমার স্তন দেখতে চান?’ এরপর আমি হুডির চেন খোলার চেষ্টা করলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘না না, লাগবে না।’

ঠিক তখনই এক মহিলা, সম্ভবত তার স্ত্রী, টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলেন। পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত তার হাত ধরলেন এবং বললেন, ‘চলো, এখনই!’
তিনি তাকে টেনে নিয়ে গেলেন, তার আগেই চারপাশে থাকা অবাক নারীরা প্রতিক্রিয়া জানাতে লাগলেন। একজন বললেন, তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যা দেখলেন। আরেকজন দুঃখ করলেন যে কেন লোকটিকে কিছু বলেননি। তিনি ভেবেছিলেন ওই পুরুষ আমাকে চেনেন বলেই স্পর্শ করেছিলেন। এমনকি একজন বললেন, আমি যেন পুলিশের কাছে অভিযোগ করি।
আমি তখন আশেপাশের সবাইকে বললাম, আমি পুরুষ ভেবে ভুল করলে তাতে কিছু মনে করতাম না। আমার মধ্যে পুরুষালি ভাব আছে। আমি একজন জৈবিক নারী—তবে আত্মার দিক থেকে যদি চিহ্নিত করতেই হয় (যদিও আমি তা করতে চাই না), তাহলে হয়তো বলব আমি প্যাংজেন্ডার বা নন-বাইনারি।
কিন্তু যা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, তা হল—তিনি ভেবেছেন, একজন মানুষকে এভাবে প্রকাশ্যে অপদস্থ করাটা তার অধিকার।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমি ভাবছিলাম, সম্প্রতি ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্ট ‘জৈবিক লিঙ্গ’-এর সংজ্ঞা নিয়ে যে রায় দিয়েছে এবং EHRC যে গাইডলাইন দিয়েছে, তা কি ওই ব্যক্তিকে সাহস জুগিয়েছে আমাকে এভাবে প্রশ্ন করতে?

আমি জানি আমার চেহারায় কিছুটা পুরুষালি ছাপ আছে। কিন্তু তিনি যদি ভেবে থাকেন আমি সিসজেন্ডার পুরুষ, তাহলে তো সামনে থেকে মুখ দেখে নিশ্চিত হতেন। আর যদি ট্রান্স পুরুষ ভেবে থাকেন, তাহলে তো আমি ঠিকই টয়লেটে গিয়েছিলাম—বর্তমান EHRC গাইডলাইন অনুযায়ী।
যদি আমি ক্যানসারের চিকিৎসা শেষে নতুন করে চুল গজাতে শুরু করি? অথবা হয়তো আমি শুধু ছোট চুল পছন্দ করি। তিনি যা-ই ভেবেছেন, তাকে এই বিচার করার অধিকার কে দিল?
ঘটনার পরে আমি কিছুতেই নিজেকে স্থির করতে পারছিলাম না।
এই ঘটনা আরও অসহজ মনে হল যখন ভেবে দেখলাম, EHRC টয়লেট নির্দেশিকা বা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সত্যিই কি কেউ নিরাপদ বোধ করছেন?
এই রায় এবং নির্দেশিকা যে আসলে কী ফল দিয়েছে, তা হল—মানুষকে আরও বেশি করে অন্যের লিঙ্গ অভিব্যক্তি নিয়ে মন্তব্য করার সুযোগ করে দিয়েছে।
ঘটনার পরে আমি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিই। তারপর থেকেই বিপুল সংখ্যক বার্তা আসতে থাকে—নারী, পুরুষ, সিসজেন্ডার, ট্রান্স, জেন্ডার-ননকনফর্মিং এবং এমনকি ক্যানসার-সারভাইভরদের কাছ থেকেও। তাঁদের অনেকের সাথেই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে।
অনেক ট্রান্স নারী জানান, তাঁরা এখন টয়লেট ব্যবহার করতে ভয় পান। কেউই আর কোথাও নিরাপদ বোধ করছেন না।
এই রায়, ইচ্ছাকৃত হোক বা না হোক, ট্রান্স, নন-বাইনারি, ইন্টারসেক্স মানুষদের টয়লেট ব্যবহারের জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তাঁদের জন্য কোনও নিরপেক্ষ স্থানই আর রইল না।
অনেকের কাছ থেকে সমর্থন পেলেও, একজন মহিলা মন্তব্য করেন—আমি নাকি ‘নারীত্বকে খাটো করছি’। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন? তিনি কোনও উত্তর দেননি।
আমার মনে হয়, কিছু মানুষ ভয় পাচ্ছেন—লিঙ্গের সংজ্ঞা যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আর তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের আত্মপরিচয় এবং জায়গার ধারণা। কিন্তু হয়তো এই বৈচিত্র্য সব সময়ই ছিল, এখন শুধু তা একটু বেশি দৃশ্যমান।
তথ্যটা স্পষ্ট—যাঁরা প্রচলিত লিঙ্গধারণার মধ্যে পড়েন না, তাঁরাও এই সমাজেরই অংশ। এটি কোনও হঠাৎ জন্ম নেওয়া প্রবণতা নয়, এটাই তাঁদের বাস্তবতা।
এটা নিশ্চিত করে বলা যায়—যাঁরা জেন্ডার-আফার্মিং সার্জারি করেছেন, তাঁরা নিজেদের সত্যিকারের জীবনের জন্যই সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কাউকে টয়লেটে ভয় দেখানোর জন্য নয়।
ইচ্ছা ছিল, আমি যদি ঐ ব্যক্তির সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে পারতাম। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সে তখন আর কোথাও ছিল না। মনে হয়েছিল, তার সঙ্গে কথা বলে তার মানসিকতা একটু বোঝা যাবে।
কারণ আমি বিশ্বাস করি, খোলামেলা সংলাপ ছাড়া আমরা পূর্বগঠিত ধারণার ভেতরের ভয়গুলো বুঝতে পারব না। যদিও আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল—তাকে বলতে, ‘চুপ করে থাকুন!’
কিন্তু মূল সমস্যা থেকে আমরা চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, এই রায় সিস নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে দেওয়া হয়েছে, লিঙ্গের সংজ্ঞা স্পষ্ট করতে। কিন্তু আদৌ কি তাই?
যাঁরা নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করেন, তাঁদের নারী সেজে টয়লেটে ঢোকার দরকার নেই। তাঁরা প্রকাশ্যেই সেই সহিংসতা চালান।
এই রায় বরং সিস এবং ট্রান্স নারী উভয়ের উপর এক ধরনের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে—যেন তাঁদের প্রমাণ করতে হয়, তাঁরা যথেষ্ট ‘নারী’ কিনা।
কিন্তু প্রকৃত প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে—কেন এখনো এত নারী—সিস হোক বা ট্রান্স—নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না?

সমস্যাটা যে কে কোন টয়লেট ব্যবহার করছেন, সেটা নয়। আসল সমস্যা, আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে সহিংসতা আর হুমকি প্রতিনিয়ত ঘোরাফেরা করে।
সূত্র মেট্রো ইউকে। লেখক কাজ কোরোনেল মিউজিক প্রডিউসার, ডিজাইনার।